সাহেদের খপ্পরে সিলেটের জাহিদের কারাভোগ-পঙ্গুত্ব, হয়েছেন নিঃস্ব

প্রকাশিত: ১:৪৭ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১৮, ২০২০

সাহেদের খপ্পরে সিলেটের জাহিদের কারাভোগ-পঙ্গুত্ব, হয়েছেন নিঃস্ব

সুরমা মেইল ডেস্ক : করোনাভাইরাস পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেপ্তার রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম প্রতারণা করতে এমন কোনো শাখা বা সেক্টর বাকি রাখেনি। তার বিচরণ ছিল প্রতারণার প্রতিটি স্তরেই। মো. জাহিদ (৪৭) নামে এক নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গেও ভয়ঙ্কর প্রতারণা করেছে সাহেদ।

 

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম জাহিদের। বাবা রহমত উল্লাহর মৃত্যুতে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে জাহিদকে। মা, স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে তার সংসার। সিলেট সিটি করপোরেশনে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন জাহিদ। মেয়র বদরউদ্দিন আহমেদ কামরানের দফতরেই তিনি ডিউটি করতেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সিলেট সিটি করপোরেশনে চাকরি করেন জাহিদ। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিলেটের কিচেন মার্কেট মামলা হয় মেয়রের বিরুদ্ধে। তখন সাহেদ মেয়রের সঙ্গে দেখা করতে সিলেট গিয়েছিল। ওই সময় সাহেদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মী জাহিদের পরিচয়। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে মোহাম্মদ সাহেদের দেওয়া ভিজিটিং কার্ডে থাকা মোবাইল নম্বরে ফোন দেয় জাহিদ। ফোন দিয়ে জাহিদ চাকরি চায় সাহেদের কাছে। সাহেদ তাকে মোটা অংকের বেতনের আশ্বাস দিয়ে ঢাকায় আসতে বলে। জাহিদ ওই বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে কুলাউড়া থেকে ঢাকায় আসে।

 

সাহেদের আশ্বাসে বাড়িতে গিয়ে ৫ শতাংশ জমি আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করেন জাহিদ। এক লাখ টাকা নিয়ে ঢাকায় আসেন। পুরো টাকা তিনি সাহেদের কাছে জমা দেন। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর শাখায় জাহিদ প্রধান নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। জাহিদ মিরপুর রিজেন্টে যোগদানের পর তার প্রতিদিনই নতুন অভিজ্ঞতা হয়। সাহেদ স্টাফদের সঙ্গে কথায় কথায় খারাপ ব্যবহার করে। কাউকে কাউকে মারধর করে। পান থেকে চুন খসলেই সাহেদ এমন ব্যবহার করতো। জাহিদ ফেব্রুয়ারি মাস চাকরি করার পরই হাসপাতালের ম্যানেজারকে বলেন, তিনি চাকরি করবেন না, জামানত ফেরত চান। পরে জাহিদকে লিখিত অব্যাহতিপত্র দিতে বলে সাহেদ। চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেতন ও জামানতের টাকার জন্য ঢাকায় থাকে জাহিদ।

 

ওই বছরের ১৩ মার্চ বেতন ও জামানত আনার জন্য রিজেন্ট হাসপাতালে যান জাহিদ। তখন তাকে হাসপাতালের ম্যানেজার ও দু’জন ব্যক্তি সাহেদের কক্ষে নিয়ে আটকে রাখে। পরে সাহেদ এসেই জাহিদের পিঠে ও কোমরে মেডিকেলের হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে থাকে। জাহিদ অজ্ঞান হয়ে পড়লে পল্লবী থানায় খবর দেয় সাহেদ। পুলিশ এসে জাহিদকে নিয়ে যায়। জ্ঞান ফেরার পর জাহিদ শুনে তাকে চুরির মামলা দিয়েছে। থানায় নেওয়ার পর পুলিশ আবার মারধর করে তাকে। এরপর বেশকিছুদিন কারাভোগ করেন তিনি।

 

ঘটনার দুই মাস পর জাহিদকে কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসে পুলিশ। তার জামিন হয়। এরপর বাড়ি ফিরেন তিনি। ২০১৭ সালের শেষের দিকে কুলাউড়া থেকে আবার ঢাকায় আসেন। সাহেদের মারধরে মেরুদণ্ডের আঘাত পেয়ে জাহিদের কোমরে ঘা হয়ে যায়। মিরপুরের স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার ভাই আশিক মোল্লার সহযোগিতায় হাসপাতালে ভর্তি হন জাহিদ। বিস্তারিত শুনে এমন ভুল যেন আর না করেন, সে ব্যাপারে আশিক মোল্লা সতর্ক করে দেন জাহিদকে।

 

পরে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে জাহিদের আইনজীবী সবকিছু ঢাকার সিএমএম’র সংশ্লিষ্ট আদালতে খুলে বলেন। বিচারক জাহিদকে খাস কামরায় নিয়ে পুরো বক্তব্য রেকর্ড করেন। জাহিদ বলেন, বিচারককে আমি সব বললাম, তিনি সব লিখলেন। এরপর আমি খাস কামরা থেকে চলে আসার সময় তিনি আমাকে কিছু টাকা দেন। আমি চলে আসি। এরপর মামলা থেকে আমি অব্যাহতি পেয়েছি।

 

মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে জাহিদ ২০১৮ সালে ফের তার জামানতের টাকার জন্য রিজেন্টের মিরপুর হাসপাতালে যায়। সেখানে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়। জাহিদ বলেন, নিরাপত্তাকর্মীরা আমাকে বলেছে সাহেদ আবার তাকে মারধর করবে। আটকে রাখবে। তারপর চলে আসি। আমি অনেকের কাছে বলেছি, থানায় মামলা দিতে চেয়েছি, কিন্তু আমাকে কেউ সহযোগিতা করেনি।

 

করোনাভাইরাসের ভুয়া রিপোর্ট প্রদানসহ নানা প্রতারণার অভিযোগে গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব-১। সিলগালা করে দেওয়া হয় রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুরের দুটি শাখা। এরপর ১৫ জুলাই ভোরে সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকা থেকে সাহেদকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

 

সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর নিজের অভিযোগ নিয়ে জাহিদ র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। র‌্যাব তাকে সহযোগিতা করার ও আইনি পরামর্শ দিয়েছে। তবে জামানতের টাকার কোনো ডকুমেন্ট না থাকায় মামলা করারও উপায় নেই তার। তবে সাহেদের মারধরের শিকার হয়ে প্রায় পঙ্গু জীবন-যাপন করছেন তিনি। জাহিদ বর্তমানে একটি গ্যাস কোম্পানির অফিস দেখাশোনা করেন।

 

সাহেদ কখনো নিজেকে আমলা, সামরিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী-নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিয়েছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে তোলা ছবি ব্যবহার করে তিনি নিজেকেও প্রভাবশালী বলে তুলে ধরতেন। তার প্রতারণার ধরণ একটি অনন্য ধরণ। তাকে বলা যায় প্রতারক জগতের আইডল। প্রতারণার মাধ্যমে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো: সাহেদ বহু মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারণাই ছিল তার প্রধান ব্যবসা। সর্বশেষ বোরকা পরে সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল তিনি। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে নিজের গ্রেপ্তার এড়াতে পারেনি ‘মহাপ্রতারক’ সাহেদ করিম।

সংবাদটি শেয়ার করুন
  •  
WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com