সিলেট ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:২৪ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১০, ২০২১
অনলাইন ডেস্ক : শিল্প-সাহিত্যে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের সমান বিচরণ। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী জাগরণের মশাল জ্বালিয়েছিলেন। অন্যদিকে সিদ্দিকা কবির লিখেছেন নারীদের সংসার সুখী করার মূল মন্ত্র। রান্না কীভাবে ভালো করা যায়, আর নতুন নতুন পদ রান্না করে প্রিয়জনের মন জয় করা যায়। এখন পর্যন্ত সুফিয়া কামাল, রাবেয়া খাতুন থেকে শুরু করে অনেক নারী সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে তাদের অবদান রেখেছেন।
বাংলায় নারীদের সাহিত্যচর্চা খুব বেশি দিন আগে শুরু হয়নি। উনিশ শতকের দিক থেকেই ঘরকন্যার কাজ সেরে সাহিত্যে নারীদের বিচরন লক্ষ করা যায়। তবে জানেন কি? বিশ্বের প্রথম কবিই ছিলেন একজন নারী। তাও আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের কথা। খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দ, প্রথম যুগের সভ্যতার ধারা তখন দেখছে পৃথিবী। সেইরকমই একটি বিখ্যাত সভ্যতা সুমেরীয় সভ্যতা। সেই সময়েরই একজন রাজকন্যা ছিলেন এনহেদুয়ান্না। প্রাচীন আক্কাদ দেশের রাজা প্রথম সারগনের কন্যা তিনি।
তবে শুধু রাজকন্যাই নন, সেই সময় প্রধান পুরোহিত ছিলেন তিনি। মূলত সুমেরীয়’র চাঁদের দেবী নান্না এবং যুদ্ধের দেবী ইনান্নার উপাসক ছিলেন তিনি। তার নামের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন এই দুই দেবী। এনহেদুয়ান্না অর্থ হচ্ছে অন্তরীক্ষ দেবী। সেই সময় এনহেদুয়ান্নার আগে কোনো নারী প্রধান পুরোহিত হননি। শুধু রাজপরিবারে জন্ম নেয়ার জন্যই নয়, নিজের যোগ্যতা দিয়েই এই পদ পেয়েছিলেন তিনি। সারগনেরও সম্পূর্ণ ভরসা ছিল তার ওপর।
চন্দ্রদেবী সুয়েনের মন্দিরে ধ্যানমগ্ন এক যুবতী, পদ্মাসনে উপবিষ্ট। দুই হাতের করতল সংযুক্ত, ঈষৎ উত্তোলিত। বুকের দুপাশে নগ্ন স্তনের ওপর দুগাছি কালো চুল। সুডৌল বাহুযুগল, উন্মুক্ত পিঠ এবং ঊরুসন্ধির সঙ্গমস্থলে স্ফীত নিতম্ব, যা শ্বেতপাথরের ওপর ছড়ানো একতাল মসৃণ মাংসপিণ্ডের মতো পড়ে আছে। ধু ধু প্রান্তরে মৌন সন্ন্যাসীর মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ন্যাড়া বৃক্ষ। গোধূলিলগ্ন। সূর্যাস্তের এক চিলতে লাল আভা এসে পড়েছে দেবী সুয়েনের কপালে শোভিত মুকুটের ওপর। প্রার্থনামগ্ন আক্কাদিয়ান যুবতীর নগ্ন অবয়ব থেকে এক অলৌকিক আলোর উজ্জ্বল আভা বিকীর্ণ হচ্ছে। পেছনে সম্রাট সারগনের নেতৃত্বে আক্কাদ সাম্রাজ্যের গণ্যমান্য লোকজন। চন্দ্র দেবীর কাছে আজ ওদের একটিই প্রার্থনা- তিনি যেন এই সাম্রাজ্যকে অসুর লুগাল এনের হাত থেকে রক্ষা করেন।
এমনই একটি চিত্রে এনহেদুয়ান্নাকে দেখা যায়। যদিও ওপরে বর্ণিত দৃশ্যটি আজ থেকে ৪ হাজার ২৭৪ বছর আগের, অর্থাৎ যিশুর জন্মের ২২৫৮ বছর আগের। এই প্রার্থনাসভার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে নারী, তার নাম এনহেদুয়ান্না। তখন তিনি ২৭ বছরের পূর্ণ যুবতী। আক্কাদের সম্রাট সারগন ও তার স্ত্রী রানি তাশলুলতুমের মেয়ে এনহেদুয়ান্না। অন্য একটি ধারণা মতে, এনহেদুয়ান্না সম্রাট সারগনের নিজের মেয়ে ছিলেন না। তবে রক্তের সম্পর্কের এক আত্মীয়া হতে পারেন।
এনহেদুয়ান্না ছিলেন অসম্ভব মেধাবী নারী, যিনি প্রার্থনাসংগীত ও কবিতা লিখতে পারতেন বলে তৎকালীন সমাজ তাকে দেবী হিসেবে পূজা করত। তার এসব লেখা পাথরে খোদাইও করা অবস্থায় পরবর্তীতে পাওয়া যায়। আর সেখান থেকেই এই নারীর সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড জানতে পারে বিশ্ব। তার পিতা সম্রাট সারগন কন্যা এনহেদুয়ান্নাকে রাজ্যের প্রধান পুরোহিতের সম্মানে ভূষিত করেন। এই পদটি মর্যাদা পেত রাজ্যের সবচেয়ে সম্মানিত পদ হিসেবে।
সারগনের মৃত্যুর পরে তার পুত্র রামিস সম্রাট হলেও এনহেদুয়ান্না তার স্বপদে বহাল থাকেন। ২২৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণকারী এই নারীই এযাবৎকালের আবিষ্কৃত প্রথম লেখক বা কবি। তিনি ৪২টি স্তবগান রচনা করেন, যা পরবর্তীকালে ৩৭টি প্রস্তরখণ্ড থেকে উদ্ধার করা হয়। এছাড়া তিনি দেবী ইনানার স্তুতি করে আরও বেশ কিছু শ্লোক রচনা করেন।
সুমেরু ভাষার ইনানাই আক্কাদিয়ান ভাষার ইস্তার। পরবর্তীকালে গ্রিকরা যাকে আফ্রোদিতি বলে শনাক্ত করে এবং রোমানরা তাকে ডাকে ভেনাস বলে, তিনি ছিলেন প্রেমের দেবী। দেবী ইনানার স্তুতি স্তাবকে সমৃদ্ধ এনহেদুয়ান্নার কবিতাগুলোই প্রার্থনাসভা-সংগীতের ভিত্তি নির্মাণ করে। সেই দিক থেকে তিনি ধর্মাবতারের কাজ করেছেন। তার ওপর রাজা সারগনের ছিল পূর্ণ আস্থা। এনহেদুয়ান্নার মাধ্যমেই তিনি সুমেরু দেব-দেবীদের স্থলে আক্কাদিয়ান দেব-দেবীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজটি করেছিলেন, রাজ্য নিষ্কণ্টক রাখার জন্য এর প্রয়োজন হয়েছিল। এনহেদুয়ান্নার কাব্যপ্রতিভা তৎকালীন মেসিপটেমিয়ার নারীদের শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করে এবং রাজবংশের নারীদের কবিতা লিখতে উৎসাহিত করে। একসময় এটা প্রায় অবধারিতই হয়ে ওঠে যে রাজকন্যা ও রাজবধূরা অবশ্যই কবিতা লিখতে জানবেন। যদিও তার সমসাময়িককালে আর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো নারী কবির সন্ধান পাওয়া যায়নি। এতে এটাও প্রতীয়মান হয় যে পার্শি বি শেলির কথাই ঠিক, কবিতা একটি ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় ব্যাপার। তিনি অবশ্য স্বর্গীয় বলতে বুঝিয়েছেন মানুষের স্বর্গীয় অনুভূতির কথা।
এনহেদুয়ান্না সম্পর্কে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ পল ক্রিওয়াসজেক বলেন, ‘তার কম্পোজিশন, যদিও এই আধুনিককালেই কেবল পুনরুদ্ধার করা হলো, সর্বকালের অনুনয়মূলক প্রার্থনার মডেল। ব্যাবিলনীয়দের মাধ্যমে এর প্রভাব হিব্রু বাইবেলে এবং প্রাচীন গ্রিক প্রার্থনাসংগীতেও এসে পড়েছে। ইতিহাসের প্রথম কবি এনহেদুয়ান্নার ভীরু শ্লোকগুলোর প্রভাব প্রথম দিকের খ্রিষ্টান চার্চেও শোনা যেত।’
তখনকার প্রেক্ষাপটে নিয়মতান্ত্রিক প্রার্থনা মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ তৈরিতে সহায়ক ছিল। রাজ্যে ও সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। যদিও দেব-দেবীরা যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতেন, অর্থাৎ রাজা বা গোত্রপ্রধানগণ ধর্মের নামে জনগণকে প্রতারিতও করতেন। তা সত্ত্বেও ধর্মই মানুষের অস্থির চিত্তকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একমাত্র উপায় ছিল। সেই দিক থেকে পৃথিবীর প্রথম কবি এনহেদুয়ান্না প্রার্থনা শ্লোক বা দেব-দেবীর স্তুতিবাক্য রচনা করে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন মানব সভ্যতার জন্য।
২২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন পৃথিবীর প্রথম কবি এই মহীয়সী নারী। তিনি কোনো পুরুষ সঙ্গী গ্রহণ করেছিলেন কি না বা তার কোনো সন্তান ছিল কিনা- এ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি কোথায়। অনুমান করা হয় যে রাজ্যের প্রধান পুরোহিত হওয়ার কারণে হয়তো সংসারের মতো জাগতিক মায়ার বাঁধনে তিনি জড়াননি।
১৯২৭ সালে ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ স্যার লিওনার্ড উলি সুমেরের ‘আর’ শহরে খননকার্যের সময় কিছু মন্দিরের সন্ধান পান। সেখানেই উল্লেখ ছিল এনহেদুয়ান্নার। শুধু সেটাই ছিল না। পাথরের গায়ে খোদাই ছিল বেশ কিছু কবিতা। যেগুলোর নিচে এনহেদুয়ান্নার স্বাক্ষরও ছিল। সেই প্রথম বিশ্ব পেল তার প্রাচীনতম লেখককে। পরবর্তীকালে সব মিলিয়ে ৪২টা মন্ত্র লিখেছিলেন এনহেদুয়ান্না। সবকটিই নান্না এবং ইনান্না-কে উদ্দেশ্য করে লেখা। এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে সেগুলো।
আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে একজন নারীর কাছ থেকেই প্রথম লেখনী পেয়েছিল বিশ্ব। উপলক্ষ আর সংখ্যা যাই হোক না কেন, সেটা তো নিজের তাগিদ থেকেই লিখেছিলেন এনহেদুয়ান্না। ২০১৫ সালে তাকে সম্মান জানিয়ে বুধ গ্রহের একটি গহ্বরের নাম রাখা হয় ‘এনহেদুয়ান্না’।
উপদেষ্টা খালেদুল ইসলাম কোহিনুর
আইন বিষয়ক উপদেষ্টাঃ এড. মোঃ রফিক আহমদ
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : মোহাম্মদ হানিফ
সম্পাদক ও প্রকাশক : বীথি রানী কর
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : ফয়সাল আহমদ
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : মো: কামরুল হাসান
নিউজ ইনচার্জ : সুনির্মল সেন
অফিস : রংমহল টাওয়ার (৪র্থ তলা),
বন্দর বাজার, সিলেট।
মোবাইল : ০১৭১৬-৯৭০৬৯৮
E-mail: surmamail1@gmail.com
Copyright-2015
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি